নবজাতকের বিলিরুবিনের পরিমাণ কমানোর উপায়
নবজাতক শিশুর জন্ডিস মানে হল শিশুটির রক্তে বিলিরুবিনের পরিমাণ স্বাভাবিক ক্ষেত্রে বেশি থাকে। আর আজ এই পোস্টে আলোচনা করব নবজাতকের বিলিরুবিনের পরিমাণ কমানোর উপায় এবং নবজাতকের জন্ডিসের স্বাভাবিক মাত্রা কত। নবজাতক শিশুদের মধ্যে জন্ডিস খুব সাধারণ একটা বিষয়। নবজাতক শিশুর রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা বেশি থাকলে এটি হয়। সাধারণত নবজাতক শিশুদের জন্ডিস ক্ষতিকারক হয় না।
নবজাতকের বিলিরুবিনের পরিমাণ কমানোর উপায় |
তার জন্যই বলা হয় প্রত্যেকটি শিশু জন্মের পর জন্ডিসে আক্রান্ত হয়। এটি বলার কারণ আছে মাতৃগর্ভে শিশু যখন বড় হয় তখন মায়ের শরীরের সাথে সংযুক্ত প্লাস্টারের মাধ্যমে এই বিলিরুবিন তার শরীর থেকে বের হয়ে যায়। তখন বিলেরুবিন ভাঙতে কাজ করতে হয় না গর্ভস্থ শিশুর লিভারকে। কিন্তু জন্মের পর তা করতে হয়। এই সময় শিশুর লিভার পুরোপুরি কার্যক্ষম হতে সময় লাগে সেজন্যই নবজাতক শিশুর কিছু সময়ের জন্য হলেও শরিলে জন্ডিস দেখা দেয়।
শিশু জন্মের ১৫ থেকে ২০ দিনের মধ্যে এটি নিজে নিজেই নিরাময় হয়ে যায়। আর যদি দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে বিলুরুবিনের মাত্রা না কমে তাহলে শিশুকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। যদি সঠিকভাবে ঘরোয়া প্রতিকার অনুশীলন করা হয় তাহলে নবজাতকের জন্ডিস নিরাময় করা সম্ভব। কিন্তু সেটা করার আগে একজন শিশু রোগ বিশেষজ্ঞের সাথে পরামর্শ করা প্রয়োজন।
পোস্ট সূচিপএ
ভূমিকা
সাধারণত শিশুর জন্মের দুই সপ্তার ভিতর জন্ডিস দেখা দেয়। নবজাতকের জন্ডিস শতকরায় ৭০ থেকে ৮০ শতাংশই ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিস হয়ে থাকে। আর এই জন্ডিস হলে ভয়ের কিছু নাই কারণ এটাতে শিশুর ক্ষতি করে না এবং এটি কিছুদিনের মধ্যে আপনা-আপনি ভাল হয়ে যায়। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই স্বাভাবিক জন্ডিসের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে এবং নানা বিপদের সম্মুখীন হইতে হতে পারে।
তাই আজকের এই পোস্টে নবজাতকের জন্ডিস এর কারণ,লক্ষণ ও করণীয় নিয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করব।
নবজাতকের জন্ডিসের লক্ষণ
নবজাতকের জন্ডিস একটি রোগ যেটা হলে শিশুর ত্বক ও চোখ হোলদেটে হয়ে যায়। নবজাতকের রক্তে অতিরিক্ত বিলিরুবিনের মাত্রা বেশি থাকার কারণে এই অবস্থার উদ্ভব হয়। এটি হলো একটি হলুদ পদার্থ যা লাল রক্ত কোষের ভাঙ্গনের জন্য আসে। শরীর থেকে বিনিরুবিন অবসারণ করতে লিভার সাহায্য করে, এই ভাবেই শরীর নিজে নিজে জন্ডিস প্রতিরোধ করে।
আরো পড়ুনঃ জীবনে চলার পথে বাধা আসবেই
বেশিরভাগ সময়েই জন্ডিস নিজে নিজেই ভালো হয়ে যায় আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় চিকিৎসার। জন্ডিসের চিকিৎসা নির্ভর করে শিশুর বয়স ও জন্ডিসের সঠিক কারণে উপর ভিত্তি করে।
ইনফ্যান্ট জন্ডিসের প্রকারভেদঃ
- শরীরবৃত্তীয় জন্ডিস
- বুকের দুধ খাওয়ানো জন্ডিস
- ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিস
আপনার শিশুর জন্ডিস হয়েছে কিনা তা চেক করতে শিশুর কপালে অথবা নাকের চামড়া আলতো করে টিপুন তারপর আপনার আঙ্গুল সরিয়ে নিন,এরপর খেয়াল করুন যে ওই জায়গাটি তুলনা চেয়ে অনেক বেশি হলুদ হয়ে আছে কিনা। নবজাতকের জন্ডিসের লক্ষণ গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো শিশুর ত্বক হলুদ হয়ে যাওয়া। নিচের দেওয়া লক্ষণ গুলো দেখলে আপনি শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করতে পারেন।
- শিশুকে খাওয়াতে সমস্যা হলে
- বাচ্চার ঘুম বেশি হলে
- শিশু জ্বরে আক্রান্ত হলে
- শিশু যদি সবসময়ই জোরে কান্দে
- প্রস্রাবের গাঢ় রং
- মলে পরিবর্তন
- পেট ফুলে যাবে
- নড়াচড়া কম করে
নবজাতকের জন্ডিস কত প্রকার
নবজাতক জন্ডিসকে সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা যায়।
- ১.ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিস
- ২.ক্লিনিক্যাল জন্ডিস
ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিসঃ
এই ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিস বা সাধারণ জন্ডিস নবজাতকের কোন ক্ষতি করে না। এটা আপনা আপনিতেই ভালো হয়ে যায়। সাধারণ জন্ডিস হলে আপনি আপনার শিশুকে সকালের রোদে একটু রাখবেন, তবে খেয়াল রাখবেন খুব কড়া রোদে রাখা যাবে না। সকালের প্রথম রোজা রাখলে ভালো হয়।
ক্লিনিক্যাল জন্ডিসঃ
শিশু মায়ের পেটে থাকা অবস্থায় মায়ের শরীর থেকে যদি কোন ধরনের ইনফেকশন জনিত সমস্যা হয় তাহলে অনেক ক্ষেত্রে নবজাতকের জন্ডিসহ আরো নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। এ ধরনের সমস্যাগুলোকে ক্লিনিক্যাল জন্ডিস বলা হয়।
এগুলো ছাড়াও নানান কারণে নবজাতক জন্ডিসে আক্রান্ত হতে পারে। নিম্নে বলা কারণ জনিত জন্ডিস হলে তা মারাত্মক জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে।
হেমোলাইটিক এনিমিয়াঃ এই জন্ডিস হলে শিশু রক্ত শূন্যতা হয়ে পড়ে এবং লিভার ও প্লীহা বড় হয়ে যায়, চোখে সাদা অংশ বেশি হলদেটে হয়ে যায়। হেমোলাইটিক এনিমিয়া হয়ে থাকলে তা যথাসময়ে চিকিৎসা না হলে শিশুর লিভার ফেইলিওর হতে পারে ও লিভার সিরোসিস হতে পারে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে বাচ্চাটি মৃত্যুমুখেও পতিত হতে পারে।
রক্তের গ্রুপ জনিত জন্ডিসঃ মায়ের রক্তের গ্রুপ যদি নেগেটিভ হয় আর নবজাতকের রক্তের গ্রুপ যদি পজেটিভ হয় সে ক্ষেত্রে বিপদজনক জন্ডিস হতে পারে। তাছাড়াও মায়ের রক্ত যদি পজেটিভ হয় তবুও এ ধরনের সমস্যা ঘটতে পারে।
ইনফেকশনঃ বাচ্চার রক্তে যদি ইনফেকশন ছড়িয়ে যায় তাহলে সেটাকে সেফটিসেমিয়া বলা হয়। আর এমনটা হলে জন্ডিস হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এক্ষেত্রে বাচ্চাকে হাসপাতালে নিয়ে.১০ থেকে ১২ দিনের মত সঠিক অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করতে হয়।
প্রি-ম্যাচুউরিটিঃ সময়ের আগে জন্মানো শিশুকে প্রি-ম্যাচুউরিটি বলা হয়। আর এইসব শিশুদের জন্ডিসের ঝুঁকি বেশি থাকে। অপরিণত জন্ম নেওয়া শিশুর জন্ডিসের মাত্রা বেশি হলে বা ১৪ মি.গ্রা./ডেসিলিটারের উপর হলে ফটো থেরাপি দিতে হয় আর যদি জন্ডিসের মাত্রা কম হয় বা ১৪ মি.গ্রা./ডেসিলিটারের নিচে হয় তাহলে বাচ্চাকে রোদের তাপ দিলে ভালো হয়ে যায়।
মায়ের ডায়াবেটিসঃ গর্ভবতী মায়ের যদি ডায়াবেটিস থাকে তাহলে সেই শিশুটি জন্ম গ্রহণের পর জন্ডিস হবার সম্ভাবনা থাকে। সেজন্য শিশুটির শর্করা লেভেল স্বাভাবিক রাখতে হবে। তার জন্য "রাইস দা ক্লক ফিডিং" অর্থাৎ বেশি বেশি মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে হবে।
আরো পড়ুনঃ
হাইপো থাইরাডিজমঃ এই হাইপো থাইরাডিজম এর ক্ষেত্রে আবার বিষয়টা উল্টা,এক্ষেত্রে শিশু মায়ের বুকের দুধ খেলেই জন্ডিস হতে পারে। তার জন্য বাচ্চার থাইরয়েড হরমোন রিপ্লেসমেন্ট করতে হয়।
উপরে উল্লেখিত কারণগুলো ছাড়াও আরো কারণ রয়েছে যেগুলোর জন্য জন্ডিস হয়। যেমন-অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অসম্পন্ন বা অর্গান ইফেক্ট থাকলে, এনজাইম ডিফেক্ট বা লিভার ব্লকেজ থাকলে, নবজাতক অর্থাৎ শিশুর পিত্তথলিতে কোন সমস্যা থাকলে, পাকস্থলীতে খাদ্য নির্গমে কোন বাধা থাকলে ও ইত্যাদি কারণে জন্ডিস হতে পারে।
নবজাতকের জন্ডিসের চিকিৎসা
নবজাতকদের মধ্যে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ জন্ডিস পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। আর এইসবের বেশির ভাগই সাধারণ জন্ডিস বা ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিস। সাধারণ জন্ডিসের ক্ষেত্রে নবজাতকের প্রতিদিন ৩০ মিনিট করে ১০ থেকে ১৫ দিন সূর্যের আলোতে রাখলেই এই সমস্যাটি ভালো হয়ে যায়। আর যদি জন্ডিসের মাত্রা বেশি মনে হয় অর্থাৎ বিলিরুবিন ১৪ বা তার থেকে বেশি হয় তাহলে হাসপাতালে নিয়ে ফটোথেরাপি দিতে হয়।
নবজাতক কত সপ্তাহে জন্মগ্রহণ করেছে,শিশুর রক্তে বিলুরুবিন এর মাত্রা কেমন, বিলিরুবিন কেমন পরিমাণে বাড়ছে এই সবের উপর ভিত্তি করে চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তা নির্ভর করে। ফটো থেরাপি মূলত এক ধরনের বেগুনি আলোক রোশনি যার মধ্য হালকা গরম আবহাওয়ায় কিছু সময়ের জন্য শিশুটিকে রাখা হয়। বেশিরভাগ শিশুই দেখা যায় এক থেকে দুইবার ফটোথেরাপি পেলেই ভালো হয়ে যায়।
আর যদি শিশুর বিলিরুবিন অতিমাত্রায় বাড়তে থাকে তাহলে হাসপাতালে চিকিৎসা করা উচিত। এমন সময় শিশুকে রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।
নবজাতকের বিলিরুবিনের পরিমাণ কমানোর উপায়
শিশুর বিলিরুবিন কমিয়ে আনার জন্য দুই ঘন্টা পরপর মায়ের বুকের দুধ পান করাতে হয়। মূলত নবজাতকের জন্ডিস কমানোর প্রধান চিকিৎসায় হচ্ছে শিশুকে বেশি বেশি দুধ পান করানো। সেজন্য আপনি আপনার শিশুকে বেশি বেশি দুধ খাওয়াবেন। যদি প্রতি দুই ঘন্টা অন্তর অন্তর বুকের দুধ খাওয়াতে পারেন তাহলে আরো ভালো হয়। নবজাতকের বিলিরুবিনের পরিমাণ যদি বেশি হয়ে থাকে তাহলে আলোক চিকিৎসা দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে।
আলোক চিকিৎসাকে ফটোথেরাপিও বলা হয়। আপনি আপনার শিশুকে সকালের প্রথম রোদ গায়ে লাগান কিন্তু খুব বেশি তাপ সম্পন্ন রোদে শিশুকে রোদে রাখবেন না।
নবজাতকের জন্ডিসের স্বাভাবিক মাত্রা কত
নবজাতকের রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা ১৪ মি.গ্রা./ডেসিলিটারের নিতে থাকে তাহলে এটাকে স্বাভাবিক জন্ডিস হিসেবে গণ্য করা যায়। আর এই জন্ডিসের জন্য কোন চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। কিন্তু যদি বিলিরুবিনের মাত্রা ০.৫ মি গ্রা/ডেসি/প্রতি ঘন্টায় বাড়তে থাকে অথবা ২৫ মি. গ্রা. ডেসিলিটারের বেশি হয় তাহলে তা বিপদজনক হিসেবে ধরে নিতে হবে।
লেখক এর মতামত
সম্মানিত পাঠক বৃন্দরা, আমাদের আজকের এই পোস্ট আপনাদের কাছে কেমন লেগেছে? এবং এই পোস্ট দ্বারা আপনি উপকৃত হতে পেরেছেন কিনা তা জানাতে নিচের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করুন। এবং এমন ইনফরমেটি আরো পোস্ট পেতে আমাদের ওয়েবসাইটের নিয়মিত সঙ্গে থাকুন। ধন্যবাদ!
ডিজি মাল্টিপ্লাই এর পোস্টে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হবে।
comment url